শব্দের খেলা
আমি জানি না গল্পটি সত্যি নাকি কল্পনা, কিন্তু আমি এমনটা অনুভব করতে চাই যেন এটি সত্যি। সত্যিই গল্পটির ভেতর ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যেন চরিত্রগুলো আমার চারপাশে হাঁটছে, কথা বলছে, হাসছে, আর কাঁদছে। হয়তো এটাই গল্পের আসল জাদু—আমাকে বাস্তবতার বাইরে নিয়ে গিয়ে এক নতুন দুনিয়ায় বসিয়ে দেয়, যেখানে সবকিছু বিশ্বাসযোগ্য লাগে, এমনকি কল্পনাও। আমি মনে করি, সেই জগৎ আমাকে আমার নিজের জীবনের বাস্তবতাকেও নতুনভাবে দেখতে শেখায়।
এক
ডেইলি স্টার ভবনের হলরুমে একটা চাপা গুঞ্জন। সাংবাদিকরা ফিসফিস করছেন। কেউ কেউ মোবাইল বের করে দ্রুত কিছু নোট নিচ্ছে।
—'ধর্ষণ' শব্দটা ব্যবহার না করতে বলেছে? কেন?
—বলছে, শব্দটা কানে বাজে।
—কিন্তু ঘটনা তো একই!
—কিন্তু নাম পাল্টালে ঘটনা নাকি হালকা হয়ে যায়!
প্রবীণ সাংবাদিক আমজাদ সাহেব ঠোঁট চেপে হাসলেন। তিনি অনেক কিছু দেখেছেন জীবনে।
—নতুন কিছু না, ভাই। আগেও দেখেছি, 'পেট্রোল বোমা'-কে বলা হয়েছে ‘অগ্নিকাণ্ড’, 'চুরি' হয়েছে ‘অধিগ্রহণ’।
তরুণ সাংবাদিক রাফি মাথা চুলকে বলল, “তাহলে 'হত্যা' শব্দটাও বদলে ফেলা উচিত! ধরা যাক, ‘অকস্মাৎ জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি’?”
চারপাশে হাসির রোল উঠল। তবে সেই হাসির মধ্যে ছিল প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ।
দুই
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি দুটো শব্দ অপছন্দ করি। এর মধ্যে একটি হলো 'ধর্ষণ'। আপনারা এটা ব্যবহার করবেন না। 'নারী নির্যাতন' বা 'নারী নিপীড়ন' বলবেন।”
সামনের সারিতে বসা সাংবাদিক লিপি ফিসফিস করে বলল, “তাহলে অপরাধীরাও হয়তো নতুন নাম পাবে! 'ধর্ষক' বলার বদলে... ‘সম্ভাব্য আচরণগত ত্রুটিপূর্ণ নাগরিক’?”
রাফি বলল, “ভালোই তো! জেলখানার নামও পাল্টে ফেলতে পারি! ‘নতুন ভবিষ্যতের পুনর্বাসন কেন্দ্র’!”
পেছন থেকে কেউ হেসে উঠল। ডিএমপি কমিশনার ভ্রু কুঁচকালেন।
তিন
বক্তৃতার মাঝখানে একজন নারী উঠে দাঁড়ালেন। মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—
“আপনারা কি শব্দ পাল্টে দিয়ে অপরাধ মুছে ফেলতে চান?”
ঘরটা নীরব হয়ে গেল।
—'নারী নির্যাতন' শুনলে মানুষ বোঝে না, ঠিক কী হয়েছে। কিন্তু 'ধর্ষণ' শুনলেই বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরে। শব্দ পাল্টে দিলে কি ভয় কমে যাবে?
বাইরে তখন সন্ধ্যার বাতাসে গুনগুন করছে এক অজানা সুর, যেন কেউ বলছে—“সত্যের শব্দ কখনো নরম হয় না।"