ছায়ার মানুষ
গল্পটি সত্য কি মিথ্যা, তা জানি না; জানবার প্রয়োজনও অনুভব করি না। দূরের কোনো দিগন্তে হয়তো তার অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে—নীরবে, নিঃশব্দে।
এক
শাকুর মজিদ ঘরের কোণে রাখা পুরোনো ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াইপ করতে থাকেন। এই ক্যামেরাটা অনেক স্মৃতি ধরে রেখেছে—আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ির ছবি, সেন্ট মার্টিনের নির্জন দ্বীপের একলা বাতিঘর, কিংবা কোনও মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী।
হঠাৎই পাশ থেকে গলা ভেসে এলো—
“আপনার কি মনে হয়, এইসব ছবি তোলা ঠিক?”
জিজ্ঞাসা করল আরমান, এক উঠতি সাংবাদিক। চোখে কৌতূহল।
শাকুর মজিদ চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন।
“কেন ঠিক হবে না?”
“মূর্তি, ভাস্কর্য, বাদ্য—সব তো নিষিদ্ধ! আপনি তো মুসলমান?”
শাকুর মজিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে বললেন, “বুঝলে আরমান, সব মানুষ একরকম চিন্তা করে না। এই যে আমাদের চারপাশে স্থাপত্য আছে, সুর আছে, ছবি আছে—এগুলো কেমন করে শুধুমাত্র হারাম হতে পারে?”
আরমান হালকা হেসে বলল, “তাহলে আপনি কি সেক্যুলার?”
শাকুর মজিদের ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
“তুমি কি শরৎচন্দ্র পড়েছ?”
“কিছু কিছু।”
“শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, মদ খেয়ে মাতাল না হওয়ার ভান করা অসম্ভব! ঠিক তেমনি, কিছু কিছু বিষয় আছে যা মানুষ হয় সম্পূর্ণ গ্রহণ করবে, নয়তো ছেড়ে দেবে। আমি শুধু জানি, জগতের সৌন্দর্যকে আলাদা করে ধর্ম দিয়ে বিচার করা যায় না।”
আরমান খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। বাইরে থেকে মাইকের শব্দ আসছে—ঈদের মিছিল চলছে। বাদ্য বাজছে, ঢোল পড়ছে। কিছু লোক নাচছে।
দুই
একজন মিছিল থেকে চেঁচিয়ে বলল, “এইসব বাদ্য-বাজনা কি ঠিক হচ্ছে? ইসলামে তো নিষেধ!”
আরেকজন বলল, “এটা আমাদের সংস্কৃতি! ইসলাম সব কিছুকে গিলে খেতে পারে না।”
শাকুর মজিদ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে তাকালেন।
“তুমি কী মনে করো, আরমান?”
আরমান একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, “আমার মনে হয়, বিশ্বাস নিয়ে কারও কিছু বলার দরকার নেই।”
শাকুর মজিদ হালকা হেসে বললেন, “একটা কথা মনে রেখো, কাঠমোল্লারা ঘুমিয়ে থাকে মানুষের মনের ভেতরেই। একটু উস্কে দিলেই জেগে ওঠে।”
তিন
ফেসবুকে শাকুর মজিদের পুরনো একটা পোস্ট নিয়ে তর্ক চলছে। কেউ বলছে, তিনি একপেশে। কেউ বলছে, তিনি ধর্মবিরোধী।
শাকুর মজিদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিলেন। ছবি তোলার জন্য বেরিয়ে পড়লেন—সময় কারও জন্য থেমে থাকে না।